চুল বড় না হবার কারণ কী?
চুলই নারীর শোভা। রেশম কালো ,লম্বা,ঘন চুলে নারীর সৌন্দর্য ফুটে ওঠে । কেশভর্তি লম্বা,ঘন চুল কে না চায় বলুনতো! অনেকেই চুল লম্বা করার জন্য কত শত প্রোডাক্ট ব্যবহার করে, কিন্তু দিনশেষে কোন ফলাফল পাওয়া যায় না। কারণ চুল লম্বা কেন হচ্ছে না ,তার সঠিক কারণ অনেকেই জানি না।
চুলের আকার ছোট হোক কিংবা বড়, চুলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বজায় রাখতে নিতে হবে, চুলের সঠিক যত্ন। চুলের বৃদ্ধি রাতারাতি হয় না, তাই ধৈর্য ধরতে হবে আর সেই সঙ্গে মেনে চলতে হবে স্বাস্থ্যকর রুটিন। এছাড়াও চুল বড় না হওয়ার অনেকগুলো কারণ আছে। চলুন জেনে নেই।
জেনেটিক কারণ
আমাদের চুলের ধরন একেকজনের একেক রকম—কারও চুল ঘন আবার কারও পাতলা। কারো চুল সহজেই লম্বা হয় আবার কারও চুল লম্বা হয় না! চুলের এই বৈচিত্র্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো জেনেটিক্স। কারণ এটি আমাদের হেয়ার গ্রোথ সার্কেলে বড় ভূমিকা রাখে। তাই তো,আমাদের প্রত্যেকের চুলের গঠন ও বৃদ্ধির ধরন আলাদা। কেউ জন্মগতভাবেই ঘন ও লম্বা চুলের অধিকারী হয় আবার কারো হয় পাতলা চুল। আর তাই অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়, চুলের সঠিক যত্ন নিলেও চুলের বৃদ্ধি হচ্ছে না।
চুল ভেঙে যাওয়া
সাধারণত একজন মানুষের চুল বছরে ১৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। তবে, চুলের বৃদ্ধি নির্ভর করে -জেনেটিক্স, হেয়ার কেয়ার রুটিন, ডায়েট, দৈনন্দিন জীবনযাপন ও স্বাস্থ্যগত অবস্থার ওপর। এক্ষেত্রে কারো ৪-৬ ইঞ্চি, আবার কারও ৬-৮ ইঞ্চি পর্যন্ত চুলের বৃদ্ধি হয়। তবে যদি দেখেন নির্দিষ্ট সময় পর চুল আর বড় হচ্ছে না এবং স্প্লিট এন্ড বেশি হচ্ছে, তাহলে এর একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে চুল ভাঙ্গার সমস্যা।
চুলের নিয়মিত যত্ন না নেওয়া, অতিরিক্ত কেমিক্যাল প্রোডাক্ট ব্যবহার করা, হিট স্টাইলিং করা ইত্যাদি কারণে চুলের ময়েশ্চার লেভেল ও ইলাস্টিসিটি কমে যায়, ফলে চুল শুষ্ক হয়ে ভাঙতে শুরু করে। এছাড়াও যাদের চুল অনেক বেশি ড্রাই, তাদের স্প্লিট এন্ড বেশি হয় ।চুলে পর্যাপ্ত ময়েশ্চারের অভাবে স্প্লিটিং শুরু হয়, যা চুলের বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে। তাই রুপ বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন, স্প্লিট এন্ড দেখা দিলে, সেই অংশ কেটে ফেলতে।
অতিরিক্ত টেনশন বা দুশ্চিন্তা
যেকোনো ধরনের শারীরিক বা মানসিক দুশ্চিন্তা চুলের বৃদ্ধিতে বাধা প্রদান করে। কারণ দুশ্চিন্তার কারনে, আমাদের শরীরে Telogen effluvium নামক একটি অবস্থা উদ্দীপিত হয়, যেখানে চুল অপরিপক্ব অবস্থায় টেলোজেন ফেজে প্রবেশ করে এবং এই পর্যায়ে চুলের বৃদ্ধি প্রায় ৩০% কমে যায় এবং এই অবস্থা থেকে উত্তরণের কোন উপায়ও নেই। তবে,ছয় মাসের মধ্যে যদি এই স্টেজ স্বাভাবিকভাবে পরিবর্তিত না হয়, তাহলে এটি হেয়ার গ্রোথ সার্কেলে প্রভাব ফেলবে যার ফলস্বরূপ চুলের বৃদ্ধি ব্যাহত হবে ও চুল পড়ার সমস্যা বেড়ে যাবে।
পোস্ট-পারটাম পিরিয়ড
সন্তান হওয়ার পর হরমোনাল ইমব্যালেন্সের কারণে ৩-৬ মাস পর্যন্ত হেয়ার লসের মাত্রা বেশি হয়। কারণ এই সময়ে মায়েরা বাচ্চার দেখাশোনা করতে গিয়ে নিজেরা হেলদি ডায়েট মেইন্টেন করে চলে না ,এক্সারসাইজ এক্টিভিটি কম থাকে এবং বিভিন্ন নিউট্রিশনাল সাপ্লিমেন্ট সেবনের প্রভাবেও চুলের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
থাইরয়েড প্রবলেম
থাইরয়েড গ্রন্থি শরীরের হরমোন ব্যালান্স করে,যা চুলের বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যখন শরীরে থাইরয়েড গ্রন্থির হরমোনাল প্রোডাকশন অস্বাভাবিক হয়ে যায়,তখন চুলের গ্রোথ সার্কেল ব্যাহত হয় । চুলের গোড়া দুর্বল হয়ে পড়ে ও গ্রোথ থেমে যায়।
অ্যালোপেশিয়া অ্যারিয়েটা
এটি একটি অটোইমিউন ডিজঅর্ডার, যেখানে শরীরের ইমিউন সিস্টেম ভুল করে হেয়ার ফলিকলের ওপর আক্রমণ করে এতে ,হেয়ার ফলিকল ক্ষতিগ্রস্ত হয়, চুলের গ্রোথ সার্কেল বাধাগ্রস্ত হয় ,হেয়ার লস হয় এবং কিছু ক্ষেত্রে পুরো শরীরের সব চুল পড়ে যায়।বিজ্ঞানীদের মতে, এই সমস্যা জেনেটিক্যালি ,ডাউন সিনড্রোম, অ্যাজমা ও থাইরয়েড ইস্যুর কারণে হয়।
হেলদি লাইফস্টাইল
চুলের স্বাস্থ্য ,শরীরের সামগ্রিক সুস্থতার ওপর নির্ভর করে। শরীর সুস্থ রাখতে রেগুলার সুষম খাবার গ্ৰহন করতে হবে , ব্যায়াম করতে হবে,পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমাতে হবে, বেশি বেশি পানি পান করতে হবে এবং সবসময় চিন্তামুক্ত থাকতে হবে। কারণ শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে আয়রন, প্রোটিন, জিংক, ভিটামিন এ ও বায়োটিনের অভাব হলে চুল দুর্বল হয়ে ভেঙে যায় বা পড়ে যায়। তাই রেগুলার খাবার ডায়েটে প্রোটিন, আয়রন, ভিটামিন C, D, E, ওমেগা-৩ যুক্ত খাবার রাখতে হবে।সেই সাথে প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট হাঁটাহাঁটি করতে হবে, ব্যায়াম করতে হবে।
কারণ ব্যায়াম করলে শরীরে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে। আর এই রক্ত সঞ্চালন স্ক্যাল্পে নিউট্রিয়েন্ট পৌঁছাতে সাহায্য করে। যার কারণে হেয়ার গ্রোথ হয়। পাশাপাশি পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমাতে হবে কারণ ঘুম শরীরকে রিকভার করে ও হরমোনাল ব্যালেন্স ঠিক রাখতে সাহায্য করে।
নির্দিষ্ট বয়স
চুলের বৃদ্ধির তিনটি প্রধান ধাপ আছে— অ্যানাজেন, ক্যাটাজেন ও টেলোজেন। অ্যানাজেন হলো চুল বৃদ্ধি পাওয়ার পর্যায় ,ক্যাটাজেন হলো মধ্যবর্তী পর্যায় ও টেলোজেন হলো চুল পড়ার পর্যায়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে চুলের অ্যানাজেন ফেজ পর্যায় ছোট হয়ে যায়, যার ফলে নতুন চুল কম গজায় এবং পুরনো চুল দ্রুত পড়ে যায়। এছাড়াও বয়স বাড়ার সাথে শরীরে এস্ট্রোজেন ও টেস্টোস্টেরনের মাত্রা পরিবর্তিত হয়, যা চুলের বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলে।
হরমোনাল ইমব্যালেন্স
থাইরয়েড, পিসিওএস, মেন্সট্রুয়েশন, মেনোপজ ও প্রেগনেন্সিজনিত নানা কারণে শরীরে হরমোনাল ইমব্যালেন্স হয়। তাই আপনি যদি এমন সমস্যায় পড়েন তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
অ্যানিমিয়া
অ্যানিমিয়া শরীরে আয়রনের ঘাটতি বা রক্তে হিমোগ্লোবিনের অভাবের কারণে হয়। যার ফলে চুলের ফলিকল পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও পুষ্টি পায় না। এতে চুলের বৃদ্ধি কমে যায় এবং অতিরিক্ত হারে চুল পড়ে।
স্ক্যাল্প ইনফেকশন
মাথার স্কেল্পে ফাঙ্গাল ইনফেকশন যেমন- খুশকি,সেবোরহেইক ডার্মাটাইটিসের কারনে চুলের গোড়া দুর্বল হয়ে যায়। এছাড়াও সোরিয়াসিস বা একজিমা স্ক্যাল্পে প্রদাহ সৃষ্টি করে এতে চুলের গোড়া দুর্বল হয়ে যায় ও চুলের বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটে।
চুলের ভুল যত্ন
নিয়মিত মাথার স্কেল্প পরিষ্কার না করা ও চুলে প্রয়োজনীয় তেল বা কন্ডিশনার ব্যবহার না করার কারণে চুলে পুষ্টির অভাব হয়। এছাড়াও চুলে অতিরিক্ত কেমিক্যাল প্রোডাক্ট ও হিট মেশিন – হেয়ার কালার, স্ট্রেটেনিং, ব্লো ড্রাই ও রিবন্ডিং করার ফলে চুলের ফলিকল দুর্বল হয়ে যায়। যা চুলের বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটায়।
এইতো জেনে নিলেন চুল বড় না হবার কারণ সম্পর্কে ।আশা করি আজকের ফিচারের মাধ্যমে আপনি খুব সহজেই বুঝতে পারবেন কি কারনে চুলের বৃদ্ধি হচ্ছে না। আর চুলের কারণ বুঝে অবশ্যই যথাযথ উপায়ে চুলের সঠিক যত্ন নিতে হবে।